রবীন্দ্রনাথের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় হয় যখন,তখন আমি বাংলা পড়তে বা লিখতে কোনো টাই পারতাম না। তাই দাদাভাই এর মুখে 'বীরপুরুষ' শুনতে শুনতে নিজের ভাবনাকে সঙ্গে করে চলে যেতাম অনেক দূরে:
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে
নিজের অজান্তেই আমার শিশু মন ভাবতে শুরু করতো আমি বুঝি মায়ের প্রহরী, প্রচন্ড প্রতাপশালী। বাস্তবে ফিরে আসতে ইচ্ছেই করতো না।
মা এর সাথে প্রথম খেলা, একে ওপরের কাছাকাছি না থাকার ব্যাথা প্রথম অনুভব করেছিলাম, আমার মা যখন আমাকে 'লুকোচুরি' পড়ে শুনিয়েছিলো:
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি
মা যখন বকাবকি করতো, আমি ভাবতাম আমিও কোনো গাছে ফুল হয়ে ফুটে উঠি। মা আমায় আর খুঁজে পাবে না, কিন্তু আমি মা কে সবসময় চোখে চোখে রাখবো। আমি দেখবো আমায় দেখতে না পেয়ে, মা আমায় কিভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মা তখন স্কুল এর শিক্ষিকা হবার জন্যে ইন্টারভিউ দিতে যেত। আমার খুব রাগ হতো । মনে মনে ভাবতাম আমাকে এত অবহেলা। আমাকে ফেলে স্কুলে পড়াতে যাবার প্লান হচ্ছে । সে আমি হতেই দেব না । যদি সত্যি সত্যি যায় তবে দেখাবো মজা । নয়নতারা গাছের ফুল ই হয়ে যাবো আমি । নিজের অগোচরেই কখন যে কবিরতার অংশ হয়ে যেতাম, কখনো বুঝতে পারি নি । ফুল হয়ে তো আর ফুটতে পারি নি , কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই মনে কুড়ি বেঁধে গিয়েছিল ।
আমাদের বাড়িতে দশ পুরুষের পুরোনো প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণ ঠাকুরের যে বিগ্রহকে নিত্য পুজো করা হয় উনার নাম 'গোপীনাথ' ঠাকুর। তাই ছোটবেলা 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শুনে শুনে ভাবতাম উনিও বুঝি আমাদের ঘরেরই আরেক ঠাকুর । মনে মনে তাই ঠাকুর ঘরে প্রনাম করার সময়, রবীন্দ্রনাথ এর উদ্দেশ্যেও একটা প্রনাম করতাম। মা কে জিজ্ঞেস ও করেছি বেশ কয়েকবার যে 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের' কোনো মূর্তি কেন নেই ঠাকুর ঘরে। মা বলেছিল যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ঠাকুর ঘরে থাকে না , সব জায়গায় দেখতে পাবে। তাই আগরতলা র রবীন্দ্র ভবনে একবার 'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মূর্তি দেখে কি যে খুশি হয়েছিলাম। আসতে আসতে বুজলাম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠাই বিশ্বজুড়ে।
"রাজব্যবস্থা" আর "বড় এসেছে বীরের ছাদে" এত বার আবৃতি করেছি যে এখন ভাবলে মনে হয় ওরা যেন ছোটবেলার একটা অংশ । কাবুলিওলার খুকী আর ডাকঘরের অমল যেন ছিল অতি পরিচিত বন্ধু।
নাচের ক্লাসে "শীতের হওয়ায় লাগলো নাচন" আর "পাগলা হওয়ার বাদল দিনে" শুনে বুঝতে শিখেছিলাম প্রত্যেক টা ঋতু কে যে আলাদা করে ভালোবাসা যায়। আমার এক দিদির কাছে প্রথম গান শেখার হাতেখড়ি । 'আয় তবে সহচরি' আমার শেখা প্রথম গান। "আমাদের ভয় কাহারে" যখন গাইতাম তখন সত্যি মনের মধ্যে কি যে একটা অদ্ভুত আনন্দ হতো । ঐ প্রথম জানা, প্রথম শেখার অনুভূতি গুলো যেন রবীন্দ্রনাথ সকলের জন্যে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। বড় হবার সাথে সাথে অনুভূতি বদলেছে। বদলেছে ভাব, ভাবনা, ভালোলাগা, মন্দলাগা, বন্ধু। কিন্তু যেটা অবিচল থেকে গেছে, সেটা হলো রবীন্দ্র রচনার সঙ্গ।
আমার ছোট কাকু আমাকে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে একটা করে খয়েরি মলাট জড়ানো বিশ্বভারতীর প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের লেখা বই উপহার দিত । বলতো খুব মূল্যবান উপহার দিচ্ছি। এখন বুঝি মূল্য দিয়ে ওই উপহারের কোনো ওজন হয় না । মহা সম্পদ দিয়েছে আমাকে । সারা জীবন দিয়ে আমি ওই সম্পদ ভেঙে চলতে পারবো, তবুও ওই সম্পদ ফুরাবে না । রবীন্দ্রনাথের
নাচের ক্লাসে "শীতের হওয়ায় লাগলো নাচন" আর "পাগলা হওয়ার বাদল দিনে" শুনে বুঝতে শিখেছিলাম প্রত্যেক টা ঋতু কে যে আলাদা করে ভালোবাসা যায়। আমার এক দিদির কাছে প্রথম গান শেখার হাতেখড়ি । 'আয় তবে সহচরি' আমার শেখা প্রথম গান। "আমাদের ভয় কাহারে" যখন গাইতাম তখন সত্যি মনের মধ্যে কি যে একটা অদ্ভুত আনন্দ হতো । ঐ প্রথম জানা, প্রথম শেখার অনুভূতি গুলো যেন রবীন্দ্রনাথ সকলের জন্যে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। বড় হবার সাথে সাথে অনুভূতি বদলেছে। বদলেছে ভাব, ভাবনা, ভালোলাগা, মন্দলাগা, বন্ধু। কিন্তু যেটা অবিচল থেকে গেছে, সেটা হলো রবীন্দ্র রচনার সঙ্গ।
আমার ছোট কাকু আমাকে প্রত্যেক বছর জন্মদিনে একটা করে খয়েরি মলাট জড়ানো বিশ্বভারতীর প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের লেখা বই উপহার দিত । বলতো খুব মূল্যবান উপহার দিচ্ছি। এখন বুঝি মূল্য দিয়ে ওই উপহারের কোনো ওজন হয় না । মহা সম্পদ দিয়েছে আমাকে । সারা জীবন দিয়ে আমি ওই সম্পদ ভেঙে চলতে পারবো, তবুও ওই সম্পদ ফুরাবে না । রবীন্দ্রনাথের
রচনা " সারা দিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে"।
আসতে আসতে তালগাছ ছাড়িয়ে, বড় হবার সাথে সাথে অনেক প্রশ্ন সাথে নিয়ে "গোড়া" আর "নিরুপমা" প্রবেশ করলো। পরে এলো এক এক করে 'চিত্রাঙ্গদা', 'চোখের বালি' আরো কত গল্প। সবগুলো যেন মনের ভেতরে মিশে যেত। কখনো কোনো কোনো গল্প পড়ে গল্পের নায়িকার প্রতি খুব রাগ হতো। কোনো কোনো গল্পের প্রধান চরিত্র কে আমি বাস্তবে খুঁজে বেড়াতাম । উনার লেখনীর মধ্যে যেটা সবচাইতে ভালো লাগতো তা হলো নায়িকাকে জীবন যুদ্ধে জিতিয়ে দেওয়া। তারা প্রাণ ত্যাগ করে হলেও সবসময় জিতে যেত ।
আসতে আসতে তালগাছ ছাড়িয়ে, বড় হবার সাথে সাথে অনেক প্রশ্ন সাথে নিয়ে "গোড়া" আর "নিরুপমা" প্রবেশ করলো। পরে এলো এক এক করে 'চিত্রাঙ্গদা', 'চোখের বালি' আরো কত গল্প। সবগুলো যেন মনের ভেতরে মিশে যেত। কখনো কোনো কোনো গল্প পড়ে গল্পের নায়িকার প্রতি খুব রাগ হতো। কোনো কোনো গল্পের প্রধান চরিত্র কে আমি বাস্তবে খুঁজে বেড়াতাম । উনার লেখনীর মধ্যে যেটা সবচাইতে ভালো লাগতো তা হলো নায়িকাকে জীবন যুদ্ধে জিতিয়ে দেওয়া। তারা প্রাণ ত্যাগ করে হলেও সবসময় জিতে যেত ।
আমার যে পিসি আমাকে সবচাইতে বেশি পড়াশোনা করতে সাহায্য করেছেন সেই পিসি কে দেখলে মনে হয়তো 'কৃষ্ণকলি' যেন রবীন্দ্রনাথ আমার পিসি কে দেখেই লিখেছিলেন। পিসির গায়ের রং চাপা হলেও কারো চেহারা যে এত সুন্দর হতে পারে তা পিসি কে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। যেন তুলি দিয়ে একে রাখা কোনো প্রতীমা । "মুক্তবেণী পিঠের 'পরে লোটে। কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ- চোখ" .. কারো সৌন্দর্য যে গায়ের রং নয় তা উনি বার বার উনার রচনার মাধ্যমে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন । নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ সব কিছু একে একে গল্পের মাধ্যমে সবাইকে জানিয়েছেন।
কোনো চরিত্র ভালো লেগে গেলে মনে হতো ইস আমার নাম যদি ওটা হতো। যেরকম 'চিত্রাঙ্গদা'।
আমার 'তনুকা' নামটা ও তো উনার লেখা কবিতা 'ক্যামেলিয়া' থেকে ধার নেওয়া। তাই ভাবি এই অহংকার তো উনি আমাকে দিয়েছেনই 'আমি গার্গী নই, মৈত্রী নই, হৈমন্তী নই, চিত্রাঙ্গদা ও নই..আমি 'তনুকা'।
অবশ্য শুধু কি প্রেম আর আবেগ? আত্মত্যাগ, শিক্ষার মর্যাদা, দেশপ্রেম সব কিছুতেই আমার জীবনে তুমি প্রথম । আর তার কখনো বিকল্প হয় নি আর হবেও না । যতই দিন কেটেছে ঘুরে ফিরে আবার সেই রবীন্দ্রনাথ এর লেখাতেই ফিরে এসেছি । জীবন সকল প্রসের উত্তর যেন এখানে । মনের সকল শান্তি আর ভালোবাসা যেন উজাড় করে দিয়ে গেছেন উনি মানবজাতির জন্যে। মন যখন খুব অবিচল হয়ে ওঠে তখন মনের ভেতর থেকে উনার ই লেখা পংক্তি গুলো গর্জে ওঠে "ভগবান তুমি যুগে যুগে দুটি পাঠিয়েছেন বারে বারে" কিংবা 'ক্ষমা করো সবে' , বলে গেল "ভালোবাসো- অন্তর হতে বিদ্ধেষ বিষ নাশো"। চারিদিকে দাঙ্গা হাঙ্গামা দেখে বার বার কি মনে ফিরে আসে না সেই দেশের খোঁজ যার স্বপ্নের বীজ রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে গেঁথে দিয়ে গেছে "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য" লিখে।
চলতে চলতে কখনো হাপিয়ে উঠলে মনের মধ্যে যে প্রথম গানের আওয়াজ ভেসে আসে তা হলো "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু "
উনি লেখার মাধ্যমে শিখিয়ে গেছেন আমরা যেন বিপদ কে ভয় না পাই "বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা ...বিপদে যেন না করি ভয়।"
কখনো কবিতার কিছু লাইন লিখতে গিয়ে আমি যখন থমকে যাই, ভাবি কি করে উনি এক জীবনে এত এত কাব্যের রচনা করলেন। এ হেনো কোনো মুহূর্ত নেই যা রবীন্দ্র রচনা তে ব্যক্ত হয় নি। তাই জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তে যেন উনার লেখার মাধ্যমে উনার উপস্থিতি অনুভব করি । রবীন্দ্রনাথ আমার ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার চিরিসখার সেই চিরসখা ই।
কখনো কবিতার কিছু লাইন লিখতে গিয়ে আমি যখন থমকে যাই, ভাবি কি করে উনি এক জীবনে এত এত কাব্যের রচনা করলেন। এ হেনো কোনো মুহূর্ত নেই যা রবীন্দ্র রচনা তে ব্যক্ত হয় নি। তাই জীবনের প্রত্যেক মুহূর্তে যেন উনার লেখার মাধ্যমে উনার উপস্থিতি অনুভব করি । রবীন্দ্রনাথ আমার ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার চিরিসখার সেই চিরসখা ই।
No comments:
Post a Comment